এবার কি বদলাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার চিত্র?
UN in Dhaka for the first মানবাধিকারের পথে এক বড় পদক্ষেপ


- আপডেট সময় : ০৫:১০:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫ ৭৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ‘গুমবিষয়ক কমিটি’ ঢাকায় সফরের অনুমতি পেয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই সফর শুধু মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ নয়, বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
🌐 জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটি কী?
জাতিসংঘের ভাষায়, এই কমিটির পূর্ণ নাম —
Committee on Enforced Disappearances (CED)।
এই কমিটি কাজ করে “International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance”–এর আওতায়।
- গুমের অভিযোগ তদন্ত ও বিশ্লেষণ করা
- দেশগুলোর আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুম প্রতিরোধে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে তা মূল্যায়ন
- ভুক্তভোগী পরিবারদের সঙ্গে দেখা করে তথ্য সংগ্রহ
- সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা
- রাষ্ট্রকে সুপারিশ প্রদান
📅 ঢাকায় সফরের প্রেক্ষাপট

২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গুমের ৬০০-এরও বেশি অভিযোগ জাতিসংঘে জমা পড়েছে।
এর আগে কয়েকবার কমিটি বাংলাদেশে সফর করতে চাইলেও সরকার অনুমতি দেয়নি। এবার প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের এই টিমকে সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সক্রিয়তা, এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের ফল বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
🧭 সফরের সম্ভাব্য কাঠামো
জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে যা করতে পারেন:
- গুমের অভিযোগ পাওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ
- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক
- সিভিল সোসাইটি, মানবাধিকার সংস্থা, আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা
- ফিল্ড ভিজিট ও তথ্য যাচাই
- সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা
📌 কেন এত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই সফর?
১. বাংলাদেশ সরকারের জবাবদিহি
সফরটি সরকারের জন্য এক ধরণের চ্যালেঞ্জ।
যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ রয়েছে, সেখানে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যুক্তিসহ।
২. মানবাধিকার সংস্থাগুলোর স্বস্তি
‘অধিকার’, ‘আসক’, ‘এলএলএস’, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই এই সফরের দাবি জানিয়ে আসছিল। তাঁদের মতে, এটি গুমের বিচার ও স্বচ্ছতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
৩. যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কূটনৈতিক নজরদারি
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ‘র্যাব’সহ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জাতিসংঘ কমিটির এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আরও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।
🧑🤝🧑 গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতিক্রিয়া


‘মায়ের ডাক’ নামক একটি সংগঠন, যারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার নিয়ে গঠিত—তারা এ সফরকে ইতিবাচক বলছে। সংগঠনের একজন সদস্য বলেন:
“আমরা ১০ বছর ধরে অপেক্ষা করছি, কেউ যেন সত্য কথা শুনে। এখন অন্তত বিশ্ব জানবে, কী ঘটে গেছে।”
তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন,
“এই সফর শুধুই কাগজে-কলমে রয়ে যাবে না তো? বাস্তব কোনো ফলাফল আসবে তো?”
🔐 সরকারের অবস্থান
“বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র। এখানে মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়। গুমের বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ এবং সরকার এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে প্রস্তুত।”
তবে সরকারি মহল থেকে আরও বলা হচ্ছে, অনেক ‘গুম’ আদতে ‘স্বেচ্ছা অন্তর্ধান’ বা ‘পারিবারিক সমস্যাজনিত’।
🎯 এই সফরের ফলাফল কী হতে পারে?
✅ ইতিবাচক সম্ভাবনা:
- আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া
- ভুক্তভোগীদের জন্য স্বীকৃতি ও ন্যায়বিচারের আশা
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর চাপ বাড়া
- নতুন আইন প্রণয়ন বা বিদ্যমান নীতিমালার সংস্কার
❌ নেতিবাচক আশঙ্কা:
- প্রতিবেদনে গুরুতর অভিযোগ উঠে আসলে কূটনৈতিক টানাপোড়েন বাড়তে পারে
- ভবিষ্যতে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে
- সরকার এটিকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলে দেখাতে পারে
📊 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই সফরকে স্বাগত জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে,
“বাংলাদেশে জাতিসংঘ গুমবিষয়ক কমিটির প্রবেশ একটি প্রশংসনীয় অগ্রগতি। আমরা চাই, সকল দেশের মতো বাংলাদেশও তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করুক।”
📝এটি কি একটি নতুন যুগের সূচনা?
বাংলাদেশে enforced disappearance বা গুমের ইতিহাস দীর্ঘ। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নয়, বরং নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্ন। জাতিসংঘ গুমবিষয়ক কমিটির এই সফর আদতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা কাঠামো ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতার একটি পরীক্ষার মুখ।
অবশ্যই এই সফর বাস্তবিক ও নিরপেক্ষ হলে বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে নতুন আলোচনা, নীতি এবং জবাবদিহির পথ খুলে যাবে।
অন্যথায়, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক ইভেন্ট হয়েই হারিয়ে যেতে পারে কাগজপত্রের স্তূপে।












