সৌদি যুবরাজ এমবিএস ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের নৈতিক নেতৃত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে।
সৌদি আরব যেভাবে ফিলিস্তিন পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে এখন

- আপডেট সময় : ০১:২৮:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৪৯ বার পড়া হয়েছে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক তৈরি করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। বহু বছর ধরে তৈরি হওয়া এই সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সৌদি রাজতন্ত্র এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক শুধু রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, বরং এতে ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) এক সময় রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন ছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোর জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করতে হবে। ২০১৭ সালে তিনি গোপনে ইসরায়েল সফর করেন এবং প্রভাবশালী ইহুদি গোষ্ঠীর মন জয় করার চেষ্টা করেন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন।

এক বছর পর, তিনি ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করা, না হলে ‘চুপ করে থাকা’। হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা চালানোর আগে এমবিএস ক্রমশ আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আব্রাহাম চুক্তি হল ইসরায়েল এবং কয়েকটি আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি। হামলার পরেও সৌদি আরব তাদের নীতি পরিবর্তন করেনি। টানা ১৫ মাস ধরে সৌদি আরবে কোনও ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি মক্কায় হাজিদের ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন বা গাজার জন্য প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ ছিল।
সৌদি যুবরাজ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে অপমানও সহ্য করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, ট্রাম্প প্রথম কোন দেশে সফর করবেন তা নিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, সৌদি আরব ভ্রমণ করলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করতে হবে। এমবিএস সে প্রস্তাব মেনে ট্রাম্পকে ফোন করে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ট্রাম্প তার দাবি আরও বাড়িয়ে চুক্তির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে যান।
ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে গাজাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এবং জানান যে গাজা পুনর্গঠনের খরচ উপসাগরীয় দেশগুলো, বিশেষত সৌদি আরব, বহন করবে। এই দাবি সৌদি আরবের জন্য বিশেষভাবে অপমানজনক ছিল। তাছাড়া, ট্রাম্প গর্বের সঙ্গে বলেন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দাবি ছাড়াই সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। কিন্তু এই বক্তব্যের মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে সৌদি আরব পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায়। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, সৌদি আরব নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাবে, যাতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চ্যানেল ফোরটিঙ্কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিদ্রূপের সুরে বলেন, সৌদি আরব চাইলে তাদের নিজ দেশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে, কারণ তাদের কাছে অনেক জমি আছে! পরে রিয়াদ আরও কঠোর ভাষায় জানায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমির মালিক, তারা কোনো অনুপ্রবেশকারী বা অভিবাসী নয়, যাতে ইসরায়েলি দখলদাররা ইচ্ছেমতো তাদের উচ্ছেদ করতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোকে চাপের মুখে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর পর, ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু একদম স্পষ্টভাবে বলেন, এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। এত দিন তিনি সৌদি যুবরাজ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করছিলেন যে, ইসরায়েল তাদের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করবে। তবে এখন তিনি ঘোষণা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নিজের শর্তেই ‘শান্তি’ চাপিয়ে দেবে এবং আরব বিশ্বকে ইসরায়েলের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।
এমন পরিস্থিতিতে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির মোড় একেবারে ঘুরে গেছে। এখন সৌদি আরব পাঁচ দশক আগের রাজা ফয়সালের আরব জাতীয়তাবাদী অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। ১৫ মাসের নীরবতার পর, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। গত রোববার গভীর রাতে মিসর ঘোষণা করেছে যে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা এক জরুরি আরব সম্মেলনের আয়োজন করবে। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হবে ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করে পুনর্বাসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা।
এই নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে কারণ কী? আসলে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতিতে ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহারে স্থানান্তরের বিষয়টি যুক্ত হওয়া। গাজার প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বিতাড়িত করা হলে তা প্রতিটি আরব দেশকেই প্রভাবিত করবে, বিশেষত সৌদি আরবকে। ইসরায়েলের আগ্রাসীভাবে এই ভূখণ্ড দখল সমগ্র অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে, এবং তা হয়তো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর ভয়াবহ পরিণতি সৌদি আরবের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে।
২০১৭ সালে উপসাগরীয় দেশগুলো ফিলিস্তিন সংকটে যে নীরবতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিল, সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। অন্যদিকে, সিরিয়ায় তাদের অবস্থান হারানোর পর এবং হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক ক্ষয়ক্ষতির ফলে ইরানের প্রতিরোধ জোট দুর্বল হয়ে পড়েছে। সৌদি আরব এখন ইরানের বিরুদ্ধে চাপ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নতুন ইরানি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন উষ্ণ, এবং সৌদি যুবরাজ এমবিএস চান এই সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে।

এমবিএস নিজেও এখন দেশের ভিতরে শক্তিশালী ও দৃঢ় অবস্থানে আছেন। তার ক্ষমতা এখন দৃঢ়, এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি আধুনিক ও সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে জনপ্রিয়। এমবিএসের ক্ষমতার শুরুর দিকে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, কিন্তু এখন আর তেমনটা নেই। সব মিলিয়ে, সৌদি আরব এখন ট্রাম্প ও ইসরায়েল থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ঝুঁকি নিতে পারে, এবং এতে তারা তাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান আবারও আরব ও মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনতে পারে।