সব কিছু দেখছেন, চুপচাপ মুচকি হাসছেন—আমার বাবা


- আপডেট সময় : ০৮:৩০:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫ ৫২ বার পড়া হয়েছে
বাবা বুঝি সব দেখছেন আর মুচকি হাসছেন
লেখক: [মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম]
ঘুম ভাঙতেই জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, সূর্যটা বেশ কড়াভাবেই চোখে আলো ফেলছে। একটু ধাতস্থ হতে না হতেই বাবার কথা মনে পড়ে গেল। আজ বাবার মৃত্যুর ৫ম বছরপূর্তি। অথচ এখনো মনে হয়, তিনি আছেন, বাড়ির ওই চেনা চেয়ারটায় বসে, চুপচাপ আমাদের সব কিছু দেখছেন আর সেই পরিচিত মুচকি হাসিটা হাসছেন।
একটা হাসি, একটা ভরসা
বাবার হাসিটা ছিল ভীষণ নির্ভরতার। কোনো কিছু বুঝিয়ে না বলেও যেন সব বুঝিয়ে দিতেন। ছোটবেলায় যখন পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তাম, কিম্বা জীবনের পথে হোঁচট খেতাম—বাবার সেই শান্ত মুখ আর মুচকি হাসিটাই ছিল সাহসের একমাত্র উৎস।
আজ এত বছর পর, যখন নিজের সন্তানদের নিয়ে হাঁটছি জীবনের পথে, তখনো অনেক সময় মনে হয়, কোনো এক ভিন্ন জগত থেকে বাবা হয়তো সব দেখছেন। কোনো ভুল করলেই মনে হয়, হয়তো তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আবার কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নিলে, যেন তিনি মুচকি হাসছেন, ঠিক যেমনটা করতেন জীবিত থাকাকালীন।
বাবার গন্ধ এখনো রয়ে গেছে,
বাবার আলমারির পুরনো জামা এখনো আছে ঘরে। মাঝে মাঝে সেই জামায় মুখ গুঁজে নিই। অদ্ভুত এক গন্ধ—মিশ্রণ বাবা, পুরোনো সময় আর শান্তির। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, পাশের ঘর থেকে হেঁটে এসে বাবার পায়ের আওয়াজ শুনছি। হয়তো এটা কল্পনা, হয়তো একটুখানি স্মৃতি—তবে সেটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা, তাই না?
আমার প্রতিটি সাফল্যে তাঁর ছায়া
সেদিন অফিস থেকে ফিরেই দেখি, আমার ছেলে স্কুলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরতেই হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, স্কুলে পুরস্কার পেলে বাবা কীভাবে আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন! আজ আমি বাবার জায়গায়, আর আমার ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
অথচ তফাৎ হলো—বাবা নেই। কিন্তু অনুভূতিতে তিনি সবসময় আছেন। আমার প্রতিটি সাফল্যে মনে হয়, বাবা সব দেখছেন। আমার জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ যেন এখনো তাঁর তত্ত্বাবধানে।
বাবা আসলে কখনো মারা যান না
আমরা ভাবি বাবা মারা গেছেন, তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে, তিনি নেই। কিন্তু সত্যি কি তিনি নেই?
নতুন কিছু শিখলে, ভুল করলে, অভিজ্ঞতা অর্জন করলে কিংবা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যথিত হলে—আমার মনে হয় বাবা দেখছেন, চুপচাপ। হয়তো হতাশ হচ্ছেন, হয়তো একটু রেগে আছেন, আবার হয়তো বলছেন, “শিখবি শিখবি, কোনো সমস্যা নেই!”
এই চুপচাপ দেখা আর মুচকি হাসি—এই যে অনুভব, এটাই প্রমাণ করে, বাবা কখনো সত্যিকার অর্থে হারিয়ে যান না।
সেই দিনগুলো, সেই গল্পগুলো
বাবার সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে গল্প করার স্মৃতি এখনো তাজা। তিনি রাজনীতির গল্প করতেন, জীবনের শিক্ষা দিতেন, আর মাঝেমাঝে তাঁর ছোটবেলার মজার ঘটনা শোনাতেন। তখন বুঝিনি, ওই সময়গুলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় “investment”।
এখন নিজের সন্তানকে বড় করতে গিয়ে বুঝি, বাবার প্রতিটি কথার মধ্যে কত জ্ঞান লুকিয়ে ছিল। বাবা হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এমন কিছু উত্তর যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোলাসা হচ্ছে।
একটা আবেগঘন চিঠি
প্রথম সন্তান হওয়ার পর আমি একদিন বাবার কবরের পাশে গিয়ে বসেছিলাম। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তাঁর উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছিলাম:
“বাবা, আজ আমি বাবা হয়েছি। কিন্তু এখনও প্রতিটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তোমার কথা মনে পড়ে। যদি তুমি থাকতে, তাহলে হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারতে—এই বাচ্চাকে কিভাবে মানুষ করব। কিন্তু আজও মনে হয়, তুমি আছো। আমার প্রতিটি ভয়, প্রতিটি অনিশ্চয়তায় তুমি পাশে থেকেছো। শুধু শব্দে না, অনুভবে…”
শেষ কথা
আজও মনে হয়, বাবা চুপ করে সব দেখছেন। আমি কাঁদলে, হয়তো তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন; আমি হাসলে, তিনি মুচকি হাসেন। আমি জানি না, বাস্তবে এই অনুভূতি সত্যি কি না—কিন্তু এটুকু জানি, এ অনুভবই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, ভরসা দেয়।
আমার কাছে বাবা আজো জীবিত—মনে, হৃদয়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে।
✨ শেষমেষ বলতে চাই:
“বাবা মানে কেবল একজন মানুষ নয়, তিনি একটা অনুভব, একটা নির্ভরতা, একটা আকাশের মতো প্রশান্তি। তিনি না থেকেও থাকেন—চুপচাপ, ভালোবাসার ছায়ার মতো।”












