ঢাকা ০১:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বিএনপির নেতৃত্বে নতুন দিগন্ত? দেশে ফিরতে পারেন তারেক রহমান কোটা ছাড়াই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সফল শারীরিক প্রতিবন্ধী উল্লাস – এক অনুপ্রেরণার গল্প ভোটের তারিখ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সিইসি’র বক্তব্য ইরান যুদ্ধ: জনমত তৈরিতে কেন ব্যর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র? গভীর বিশ্লেষণ আবু সাঈদ হত্যা মামলার ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ৪ জন কারাগারে জগন্নাথের ছাত্রদের জন্য আধুনিক হোস্টেল চালু আস-সুন্নাহর মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস নির্বাচন করবেন? বিএনপি নেতার সন্দেহে রাজনীতিতে নতুন আলোচনার ঝড় উঠেছে দরজা ভেঙে গণধর্ষণ: মুরাদনগরে প্রধান আসামিসহ পাঁচজন আটক উমামা ফাতেমার পদত্যাগ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নতুন সংকট নরসংদীতে রক্তাক্ত রাজনীতি: গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে প্রাণ ঝরছে

১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে ওএইচসিএইচআর। ১১৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আজ প্রকাশ করা হয়েছে।প্রতিবেদনের বলা হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংখ্যা জাতিসংঘ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৫৭:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১০৬ বার পড়া হয়েছে

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংখ্যা জাতিসংঘ

আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল জানিয়েছে যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত সরকার এবং সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গুলি চালানো, গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং চিকিৎসা প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সরাসরি অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া গেছে। ১১৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে সেই সময়ের নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।

ওএইচসিএইচআরের এই প্রতিবেদনটি আজ বুধবার জেনেভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রতিবেদনের খসড়া পাঠায় এবং কোনো মতামত থাকলে তা সংযুক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট ও গাজীপুরসহ আটটি শহরে অনুসন্ধান চালায়। বিশেষভাবে, যেসব শহরে বিক্ষোভের তীব্রতা বেশি ছিল, সেখানেই সরেজমিনে তদন্ত চালায় দলটি।

প্রতিবেদন তৈরির জন্য অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে ২৩০টিরও বেশি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। পাশাপাশি, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই ৩৬ জনের মধ্যে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা ছিলেন, যারা সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলনকারী ও ভিন্নমত দমন কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত নির্দেশনায় এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আন্দোলনের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেল (এনটিএমসি), পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটসহ একাধিক সংস্থা আন্দোলনকারীদের সহিংসভাবে দমনে যুক্ত ছিল এবং সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।

মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের কৌশল

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলন দমন ও বিরোধী মত রোধের অংশ হিসেবে পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কোর কমিটির নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে সভাপতিত্ব করতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসব বৈঠকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি বাহিনীগুলোর মাঠপর্যায়ে মোতায়েন ও নির্দিষ্ট অভিযান নিয়ে আলোচনা হতো।

এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমন্বিত কার্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে সরাসরি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়মিতভাবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর প্রধানদের কাছ থেকে সরাসরি প্রতিবেদন গ্রহণ করতেন। ২১ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনে আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে সতর্ক করা হয়েছিল। একই ধরনের উদ্বেগ আগস্টের শুরুতেও তাঁর কাছে তুলে ধরা হয়। ২৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তিনি আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়গুলো উত্থাপন করেন। আন্দোলন চলাকালীন তিনি ও তাঁর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা সরাসরি এবং টেলিফোনের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আদেশ দিতেন ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন।

জাতিসংঘের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনগত কাঠামোর মধ্যেই বাহিনীকে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে বাহিনীগুলো নিজেরা মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। তবে জাতিসংঘ এসব দাবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো ঢাকা ও অন্যান্য শহরে একই ধরনের দমনমূলক কৌশল প্রয়োগ করেছে। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক প্রতিবেদন পেয়েছিল, তবে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে শেখ হাসিনাসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এসব ঘটনা গোপন করতে সক্রিয় ছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করতেন।

সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুসারে, রাজনৈতিক নেতৃত্বই সরাসরি মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৮ জুলাই কোর কমিটির বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-কে আন্দোলনকারীদের ওপর আরও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত স্বাধীন তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। এতে উঠে এসেছে যে, পূর্ববর্তী সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে হাজারো আন্দোলনকারীকে গুরুতর আহত করেছে। নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল।

প্রতিবেদন অনুসারে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং নিয়মিত মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২১ জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে তাঁদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে সতর্কতা দেওয়া হলেও, তাঁরা বিজিবি, র‌্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কঠোর দমনপীড়নের নির্দেশ দেন। ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা জবাবদিহিতার উদ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা যায়নি।

আন্দোলনের বিস্তৃতি ও সুপারিশসমূহ

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের পেছনে শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের দাবি প্রধান কারণ ছিল না। বরং দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এসব কারণেই লাখো মানুষ, নারী ও শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে, ধর্ম ও পেশার বিভেদ ভুলে সত্যিকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে এই আন্দোলনে যোগ দেয়।

হতাহতের পরিসংখ্যান

প্রতিবেদনে সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত মারণাস্ত্র ও শটগানের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া হাজারো মানুষ গুরুতর আহত বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন, এবং ১১,৭০০-এর বেশি মানুষকে পুলিশ ও র‍্যাব গ্রেপ্তার করেছে।

নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু, যাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ‘টার্গেট কিলিং’ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী শুধু হত্যাই করেনি, বরং নির্বিচার গ্রেপ্তার, অমানবিক নির্যাতন এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলনের শুরুর দিকেই নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি দলের সদস্যরা নারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, যা জাতিসংঘ প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে অভিহিত করেছে।

বিশেষ ঘটনাসমূহ

প্রতিবেদনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হওয়া এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবু সাঈদ যখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিলেন

জাতিসংঘের সুপারিশসমূহ

জাতিসংঘের অনুসন্ধান দল ৫০টির বেশি সুপারিশ প্রদান করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  • নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত: সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে।
  • র‍্যাব ও এনটিএমসি বিলুপ্ত করা: এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেল) নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার:
    • অভিযোগহীন সদস্যদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো।
    • বিজিবি, ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আইনি ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করা।
    • আনসার ও বিজিবিকে সামরিক বাহিনী থেকে মুক্ত রাখা।
    • সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কার্যক্রমের সময়সীমা নির্ধারণ করা
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তদন্ত করা

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার আহ্বান

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং বিপুলসংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না।

নির্বাচন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার

জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

  • সব রাজনৈতিক দলের সমান প্রচারণার সুযোগ নিশ্চিত করা।
  • নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা করা, যাতে তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পারে।
  • বিচারবিভাগের সংস্কার নিশ্চিত করা, যাতে এটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
  • সর্বোচ্চ দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের চলমানতা

জাতিসংঘের অনুসন্ধান অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ এখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, গণহারে ভিত্তিহীন মামলা দিচ্ছে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। যদিও সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলায় অভিযুক্ত ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, তবু বেশিরভাগ অপরাধী দায়মুক্তি ভোগ করছে

তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৯৮,১৩৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫,০৩৩ জনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তবে জাতিসংঘ পর্যালোচনায় দেখেছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, বরং জনগণের চাপের মুখে নিরীহ মানুষকে আটক করা হয়েছে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন

অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের কিছু সংশোধন এনেছে, তবে জাতিসংঘ মনে করে এখনো মৃত্যুদণ্ড ও অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।

তদন্তের সূচনা ও জাতিসংঘের ভূমিকা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জুলাই-আগস্টের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করেন।

গত বছরের ২২ থেকে ২৯ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকা সফর করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান দল বাংলাদেশে অবস্থান করে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ১৪ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে

আরো জানতে পড়ুন

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে ওএইচসিএইচআর। ১১৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আজ প্রকাশ করা হয়েছে।প্রতিবেদনের বলা হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংখ্যা জাতিসংঘ

আপডেট সময় : ০২:৫৭:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল জানিয়েছে যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত সরকার এবং সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গুলি চালানো, গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং চিকিৎসা প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সরাসরি অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া গেছে। ১১৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে সেই সময়ের নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।

ওএইচসিএইচআরের এই প্রতিবেদনটি আজ বুধবার জেনেভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রতিবেদনের খসড়া পাঠায় এবং কোনো মতামত থাকলে তা সংযুক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট ও গাজীপুরসহ আটটি শহরে অনুসন্ধান চালায়। বিশেষভাবে, যেসব শহরে বিক্ষোভের তীব্রতা বেশি ছিল, সেখানেই সরেজমিনে তদন্ত চালায় দলটি।

প্রতিবেদন তৈরির জন্য অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে ২৩০টিরও বেশি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। পাশাপাশি, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই ৩৬ জনের মধ্যে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা ছিলেন, যারা সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলনকারী ও ভিন্নমত দমন কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত নির্দেশনায় এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আন্দোলনের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেল (এনটিএমসি), পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটসহ একাধিক সংস্থা আন্দোলনকারীদের সহিংসভাবে দমনে যুক্ত ছিল এবং সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।

মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের কৌশল

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলন দমন ও বিরোধী মত রোধের অংশ হিসেবে পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কোর কমিটির নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে সভাপতিত্ব করতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসব বৈঠকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি বাহিনীগুলোর মাঠপর্যায়ে মোতায়েন ও নির্দিষ্ট অভিযান নিয়ে আলোচনা হতো।

এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমন্বিত কার্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে সরাসরি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়মিতভাবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর প্রধানদের কাছ থেকে সরাসরি প্রতিবেদন গ্রহণ করতেন। ২১ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনে আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে সতর্ক করা হয়েছিল। একই ধরনের উদ্বেগ আগস্টের শুরুতেও তাঁর কাছে তুলে ধরা হয়। ২৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তিনি আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়গুলো উত্থাপন করেন। আন্দোলন চলাকালীন তিনি ও তাঁর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা সরাসরি এবং টেলিফোনের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আদেশ দিতেন ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন।

জাতিসংঘের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনগত কাঠামোর মধ্যেই বাহিনীকে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে বাহিনীগুলো নিজেরা মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। তবে জাতিসংঘ এসব দাবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো ঢাকা ও অন্যান্য শহরে একই ধরনের দমনমূলক কৌশল প্রয়োগ করেছে। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক প্রতিবেদন পেয়েছিল, তবে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে শেখ হাসিনাসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এসব ঘটনা গোপন করতে সক্রিয় ছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করতেন।

সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুসারে, রাজনৈতিক নেতৃত্বই সরাসরি মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৮ জুলাই কোর কমিটির বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-কে আন্দোলনকারীদের ওপর আরও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত স্বাধীন তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। এতে উঠে এসেছে যে, পূর্ববর্তী সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে হাজারো আন্দোলনকারীকে গুরুতর আহত করেছে। নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল।

প্রতিবেদন অনুসারে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং নিয়মিত মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২১ জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে তাঁদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে সতর্কতা দেওয়া হলেও, তাঁরা বিজিবি, র‌্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কঠোর দমনপীড়নের নির্দেশ দেন। ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা জবাবদিহিতার উদ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা যায়নি।

আন্দোলনের বিস্তৃতি ও সুপারিশসমূহ

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের পেছনে শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের দাবি প্রধান কারণ ছিল না। বরং দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এসব কারণেই লাখো মানুষ, নারী ও শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে, ধর্ম ও পেশার বিভেদ ভুলে সত্যিকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে এই আন্দোলনে যোগ দেয়।

হতাহতের পরিসংখ্যান

প্রতিবেদনে সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত মারণাস্ত্র ও শটগানের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া হাজারো মানুষ গুরুতর আহত বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন, এবং ১১,৭০০-এর বেশি মানুষকে পুলিশ ও র‍্যাব গ্রেপ্তার করেছে।

নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু, যাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ‘টার্গেট কিলিং’ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী শুধু হত্যাই করেনি, বরং নির্বিচার গ্রেপ্তার, অমানবিক নির্যাতন এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলনের শুরুর দিকেই নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি দলের সদস্যরা নারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, যা জাতিসংঘ প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে অভিহিত করেছে।

বিশেষ ঘটনাসমূহ

প্রতিবেদনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হওয়া এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবু সাঈদ যখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিলেন

জাতিসংঘের সুপারিশসমূহ

জাতিসংঘের অনুসন্ধান দল ৫০টির বেশি সুপারিশ প্রদান করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  • নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত: সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে।
  • র‍্যাব ও এনটিএমসি বিলুপ্ত করা: এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেল) নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার:
    • অভিযোগহীন সদস্যদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো।
    • বিজিবি, ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আইনি ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করা।
    • আনসার ও বিজিবিকে সামরিক বাহিনী থেকে মুক্ত রাখা।
    • সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কার্যক্রমের সময়সীমা নির্ধারণ করা
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তদন্ত করা

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার আহ্বান

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং বিপুলসংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না।

নির্বাচন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার

জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

  • সব রাজনৈতিক দলের সমান প্রচারণার সুযোগ নিশ্চিত করা।
  • নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা করা, যাতে তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পারে।
  • বিচারবিভাগের সংস্কার নিশ্চিত করা, যাতে এটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
  • সর্বোচ্চ দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের চলমানতা

জাতিসংঘের অনুসন্ধান অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ এখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, গণহারে ভিত্তিহীন মামলা দিচ্ছে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। যদিও সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলায় অভিযুক্ত ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, তবু বেশিরভাগ অপরাধী দায়মুক্তি ভোগ করছে

তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৯৮,১৩৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫,০৩৩ জনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তবে জাতিসংঘ পর্যালোচনায় দেখেছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, বরং জনগণের চাপের মুখে নিরীহ মানুষকে আটক করা হয়েছে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন

অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের কিছু সংশোধন এনেছে, তবে জাতিসংঘ মনে করে এখনো মৃত্যুদণ্ড ও অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।

তদন্তের সূচনা ও জাতিসংঘের ভূমিকা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জুলাই-আগস্টের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করেন।

গত বছরের ২২ থেকে ২৯ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকা সফর করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান দল বাংলাদেশে অবস্থান করে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ১৪ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে

আরো জানতে পড়ুন