মানবিক ব্যতিক্রম নিয়ে ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
মাকে বাঁচাতে ছুটে গেল ছাত্রী, কিন্তু পরীক্ষায় বসতে পারল না


- আপডেট সময় : ০৫:৫৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫ ৫২ বার পড়া হয়েছে
মানবিকতার স্থান কোথায়? বিশেষ করে তখন, যখন কঠোর নিয়মের মুখোমুখি হয় এক হৃদয়বিদারক বাস্তবতা। ঠিক এমন একটি প্রশ্ন উঠেছে রাজধানীর একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা ঘিরে—যেখানে একজন মেয়ে পরীক্ষার্থী তার অসুস্থ মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে কেন্দ্রের দিকে ছুটে এসে পৌঁছায় কিছুটা দেরিতে। পরীক্ষার নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। বিষয়টি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেস উইং-এর বিবেচনায় রয়েছে।
এই ঘটনা কেবল একটি শিক্ষার্থীর জীবনের মোড় ঘোরানোর দুঃখজনক অধ্যায় নয়, বরং এটি আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো ও মানবিক বিবেচনার মাঝে ভারসাম্য খোঁজার চ্যালেঞ্জও বটে।
ঘটনাটির বিস্তারিত
সূত্র মতে, বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর একটি কেন্দ্রে জাতীয় পর্যায়ের একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১০টা থেকে ১টা। কিন্তু এক পরীক্ষার্থী সকাল ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ কেন্দ্রে পৌঁছায়। কেন্দ্রে পৌঁছে জানায় যে তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, ফলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। পরে সে সেখান থেকে সরাসরি কেন্দ্রে আসে।
কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষার নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর কেউ প্রবেশ করলে তা নিয়মবিরুদ্ধ। ফলে তাকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি।
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন—নিয়মই কি সব? নাকি মানবিক বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেস উইং একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেয়।
তারা জানায়,
“ঘটনাটি অত্যন্ত মানবিক এবং স্পর্শকাতর। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছি এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
এছাড়া, প্রেস উইং আরও উল্লেখ করে যে, “সুনির্দিষ্ট তথ্য যাচাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। শিক্ষা শুধু নিয়ম নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনেকেই লেখেন—
- “একজন মেয়ে তার মাকে বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এরপর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছে। এমন একজনকে কি না বলা হলো—তুমি নিয়ম ভেঙেছো!”
- “নিয়মের বাইরে গিয়ে একবারই না হয় মানবিকতা দেখানো যেত। প্রশাসনের এমন ‘রোবটিক’ আচরণ হতাশাজনক।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
শিক্ষাবিদদের মতে, প্রশাসনের উচিত হবে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন,
“আমরা যখন শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখাতে চাই, তখন আমাদের নিজেদেরও সেই মূল্যবোধ ধারণ করতে হবে। নিয়ম মানি, তবে মানবিক ব্যতিক্রমগুলোতে নমনীয় হওয়াও জরুরি।”
অন্যদিকে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান,
“একটি ব্যতিক্রম যদি উদাহরণ হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও এমন অনুরোধ আসবে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া জটিল হয়ে পড়ে। তবে এই বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো যেতে পারে।”
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা সংক্রান্ত যে নীতিমালা রয়েছে, তাতে পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের পরে কোনো পরীক্ষার্থী প্রবেশ করতে পারে না—এমন নিয়ম সাধারণত কঠোরভাবে মানা হয়।
তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রসচিব, বোর্ড কিংবা মন্ত্রণালয় চাইলে ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, শিক্ষার্থীটি চাইলে লিখিতভাবে আবেদন করতে পারে, যেটি তদন্ত সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে।
মানবিক মূল্যবোধ বনাম প্রশাসনিক নিয়ম
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—
শিক্ষা কি শুধুই নিয়ম, না কি মূল্যবোধের চর্চা?
যে মেয়ে তার মাকে বাঁচাতে দৌঁড়েছে, তার মানবিকতা কি তার “পরীক্ষা” নয়? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতা তখনই হবে, যখন সেটি শুধু ভালো গ্রেড নয়—ভালো মানুষও গড়বে।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা
এই ঘটনা প্রশাসনের জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে। এমন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য স্পষ্ট ও নমনীয় একটি নীতিমালা থাকা উচিত। যেমন:
- প্রমাণসহ বিশেষ আবেদন গ্রহণের ব্যবস্থা
- মানবিক পরিস্থিতিতে বিকল্প সময়ের পরীক্ষা
- অনলাইন বা আলাদা কেন্দ্রে পরবর্তী সুযোগ
এই উদ্যোগগুলো পরীক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করবে এবং সমাজে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বাস বাড়াবে।
মাকে হাসপাতালে রেখে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানো সেই মেয়েটির জীবনের একটি সন্ধিক্ষণ। প্রশাসনের হাতে এখন একটি সুযোগ—নিয়মের খাতিরে নয়, মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
আমরা আশাবাদী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি উদাহরণ তৈরি করবে—যেখানে নিয়মের সাথে মূল্যবোধেরও জায়গা থাকবে।












