নগদের পর্ষদে কৌশলগত পরিবর্তন
নগদ পেল নতুন চেয়ারম্যান, শুরু হচ্ছে নতুন অধ্যায়


- আপডেট সময় : ১১:০৩:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫ ৭২ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) খাতে অন্যতম প্রধান ও দ্রুতগতিতে বিস্তৃত প্রতিষ্ঠান নগদ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সম্প্রতি পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং এর নেতৃত্বে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন কায়জার আহমেদ চৌধুরী। ব্যাংকিং খাতে তিন দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই পেশাজীবীর নিয়োগকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
নগদের চলমান অগ্রযাত্রা
‘নগদ’ ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অংশীদারিত্বে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি খুব অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় ডিজিটাল লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকায়, নগদের ব্যবহারও ত্বরান্বিত হয়।
বর্তমানে নগদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৮ কোটির বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ। শিক্ষা উপবৃত্তি, সামাজিক সুরক্ষা ভাতা, সরকারি প্রণোদনার টাকা পৌঁছে দেওয়ায় ‘নগদ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কেন পুনর্গঠন?
নগদের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের পুনর্গঠন অনেকটাই সময়োপযোগী ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একদিকে যেখানে এমএফএস খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, অন্যদিকে গ্রাহকের চাহিদাও পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে এই ধরনের পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন চেয়ারম্যান: কে এই কায়জার আহমেদ চৌধুরী?
কায়জার আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অত্যন্ত পরিচিত ও অভিজ্ঞ নাম। তার পেশাগত জীবন শুরু হয় আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সংস্থা সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে। এরপর তিনি এনসিসি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এবি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ পদে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি ছিলেন প্রাইম ব্যাংকের উপদেষ্টা।
তিনি একজন স্বীকৃত আর্থিক বিশ্লেষক ও কৌশলগত নেতৃত্বদানে দক্ষ ব্যক্তি। তার নেতৃত্বে একাধিক ব্যাংক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ে উন্নত হয়েছে। এখন এই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগাতে যাচ্ছেন তিনি ‘নগদ’-এ।
তার নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর এ মিশুক বলেন:
“আমরা বিশ্বাস করি, কায়জার আহমেদ চৌধুরীর মতো একজন অভিজ্ঞ এবং প্রাজ্ঞ পেশাজীবী আমাদের পর্ষদের নেতৃত্বে থাকলে নগদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে। তার নেতৃত্বে আমরা আরও দ্রুত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে এগিয়ে যাব।”
কী পরিবর্তন আসতে পারে এই পুনর্গঠনের মাধ্যমে?
নতুন ব্যবস্থাপনা পর্ষদের মাধ্যমে ‘নগদ’ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চায়—
- টেকসই ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গঠন
পর্ষদের সদস্যদের পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানটি আরও দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পরিচালনার দিকে এগোবে। - প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সম্প্রসারণ
ডিজিটাল লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হতে পারে। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), বিগ ডেটা এনালাইটিক্স এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার। - আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সেবা প্রদান
নগদ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থ স্থানান্তর বা ক্রস-বর্ডার ট্রান্সফার সেবা চালু করার পরিকল্পনা করতে পারে। - IPO বা শেয়ার বাজারে আসার প্রস্তুতি
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নগদ ভবিষ্যতে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন পর্ষদ সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে পারে। - গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র (Innovation Lab)
দেশের ফিনটেক খাতে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
গ্রাহকদের জন্য সম্ভাব্য সুবিধা
পর্ষদ পুনর্গঠনের পর গ্রাহকরা যেসব পরিবর্তনের আশায় থাকতে পারেন:
- আরও দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সেবা
- ইউজার ফ্রেন্ডলি অ্যাপ ইন্টারফেস
- গ্রাহক সেবা উন্নয়ন
- নতুন নতুন বিল পেমেন্ট ও লোন সুবিধা
- গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষায় উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তি বিশ্লেষক ড. আরিফ হোসেন বলেন:
“নগদ যেমন দ্রুত বড় হয়েছে, তেমনিভাবে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করাও জরুরি। কায়জার আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে এমএফএস খাতে যেমন বিকাশ, রকেট, উপায়-এর মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, নগদকে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।”
প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হবে
বাংলাদেশে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস খাত দিন দিন প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। ‘বিকাশ’ এখনও শীর্ষে থাকলেও নগদের দ্রুত প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে, সরকারি ভাতাসমূহ নগদের মাধ্যমে সরবরাহ করায় প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রচারণা উভয়ই বেড়েছে।
তবে শীর্ষে থাকতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে হবে, এবং লেনদেনের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। এই জায়গাতেই নতুন পর্ষদ মূল ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকার ও ডাক বিভাগের ভূমিকা
‘নগদ’ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অংশীদারিত্বে পরিচালিত হওয়ায় সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নজরদারি রয়েছে। এই কারণে নগদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কর্পোরেট গভর্নেন্স আরও সুসংগঠিত হওয়া জরুরি ছিল। নতুন পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
নগদের এই পর্ষদ পুনর্গঠন শুধু একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়—বরং এটি একটি কৌশলগত রূপান্তর। দেশের কোটি কোটি মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নগদ আন্তর্জাতিক ফিনটেক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে।
সেক্ষেত্রে এই নতুন নেতৃত্ব কতটা দূরদর্শী এবং কার্যকর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে, তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে।












