কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
জীবনে আমরা এমন অস্থির সময় পার করবো

- আপডেট সময় : ০৫:৪৪:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৭৮ বার পড়া হয়েছে
এই ধরনের সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সত্যিই উদ্বেগজনক। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয় এবং অনেক ক্ষতি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি অনেক সময় হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলেও, সহিংস পন্থা কখনোই কোনো সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে না।
এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং জনগণ উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে সমস্যা সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করার। আপনার এলাকার পরিস্থিতি যদি খুবই খারাপ হয়, তাহলে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আশা করি, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং সব পক্ষই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং এর ফলে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট পুনরায় চালু করা হয়েছে। এই কয়েকদিনে প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা, এবং সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) এই লেখাটি ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
খবরের কাগজ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যায় না। আমি যেখানে থাকি, সেখানে এখন খবরের কাগজ পাই না। ইন্টারনেট বন্ধ। টেলিভিশনে যে সংবাদ দেখি, সেগুলো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত বলে মনে হয়। আসল পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছি না।

আরো পড়ুন
শুরুটা হয়েছিল নিরীহ একটি আন্দোলন দিয়ে। ২০১৮ সালেও একবার কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। তখন ছাত্রদের দমন করতে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীকে পথে নামতে দেখেছি। সে বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমনেও হেলমেট বাহিনী নেমেছিল। তারা ছাত্রদের, সাংবাদিকদের পিটিয়েছিল। এই হেলমেট বাহিনী কারা, সেটা সবাই জানে। এবারও আমরা একই ঘটনা দেখলাম।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের প্রথম কয়েক দিনের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত উক্তিকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হলো। মধ্যরাতে হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করল।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিলেন। এরপরই আমরা দেখলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল। পিটিয়ে ছাত্রদের আহত করল।
এখনকার ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র নয়। তারা অনেকে জোর করে ক্যানটিনে খায়, রুম দখল করে রাখে এবং সাধারণ ছাত্রদের গণরুম নামের একটি জেলখানায় থাকতে বাধ্য করে। মিছিল-মিটিংয়ে না গেলে তাদের পেটানো হয়।
এগুলো বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি উপলক্ষ; ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভই আন্দোলনটিকে এত বড় করে তুলেছে। সেই ক্ষোভ থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। হেলমেট বাহিনী তাদের পিটায়, ফলে আন্দোলন ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যায়। আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্র কোথায়? লুঙ্গি পরা লোকজন কেন আন্দোলনে আসছে? এ ধরনের প্রশ্ন উদ্দেশ্যমূলক। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তো লুঙ্গি পরে। রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, দোকানদার, পরিবহন শ্রমিক—সব ধরনের মানুষই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের অনাচার, দুর্নীতি, শোষণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। এখন আর আন্দোলনটা শুধু ছাত্রদের হাতে নেই। এর আগে সব আন্দোলনেই আমরা এ রকমটা দেখেছি।
এই দেশে আন্দোলনের সময় জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুরের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দলগুলো এবং জামায়াতে ইসলামী একসঙ্গে অনেক গাড়ি পুড়িয়েছে এবং ভবনে আগুন দিয়েছে। তারা মনে করত যে গাড়ি পোড়ানো এবং ভবনে আগুন দিলে দেশে গণতন্ত্র আসবে।
১৯৯১ সাল থেকেই আমরা গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ দেখতে শুরু করলাম। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর, দুই বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ ও জামায়াত মিলে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুর শুরু করে। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি ও জামায়াত আবারও গাড়ি পোড়ানো এবং ভাঙচুর শুরু করে। এভাবেই দেশের রাজনীতি চলেছে।

আরো পড়ুন
আন্দোলন হলেই মানুষ গাড়ি পোড়ায় এবং ভাঙচুর করে। এর পেছনে একটি কারণ হলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকা। আবার আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও ঢুকে পড়ে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যেমন রাজনৈতিক দল রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সংস্থার লোকও থাকে, যারা সুযোগ বুঝে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।
এবারের আন্দোলনেও অনেক সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে এবং অনেক গাড়ি পুড়েছে। এসব জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু তারা তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ক্ষমতাসীনদের আচরণে সংযম আনা।
১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বামপন্থী কর্মী আসাদ নিহত হওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল। পুলিশ খুব কাছ থেকে আসাদকে গুলি করেছিল, কিন্তু সেই পুলিশের কোনো বিচার হয়নি। আসাদকে গুলি করেছিলেন একজন বাঙালি পুলিশ।
এরপর ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় একটি গণবিস্ফোরণ ঘটে। তিন–চারজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যে গেস্টহাউসে ছিলেন, সেখানে আগুন দেওয়া হয়, দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজের অফিসেও আগুন দেওয়া হয়। এসবই ছিল ছাত্র-জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাবলিকে পরবর্তীকালে আমাদের রাজনীতিবিদেরা গৌরবান্বিত করেছেন।
সরকার বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সরকার পরিচালনা করছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাহলে কেন তারা ষড়যন্ত্র আগে থেকে শনাক্ত করতে পারছে না? বাস্তবে, আমরা একটি স্থূল রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে আছি। এর কারণ হলো ১৫ বছর ধরে দেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হয়নি, যা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তৈরি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও আন্দোলনের জন্য উপলক্ষ খুঁজছে।
আন্দোলনের সময় পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ছুড়েছে এবং গুলি চালিয়েছে। এসব গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল, এবং সাউন্ড গ্রেনেড কার টাকায় কেনা? এগুলো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা হয়। আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই উক্তি, ‘আমার জনগণের টাকায় অস্ত্র কেনা হয়, সেই অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, আমার জনগণের বুকের ওপরে?’
গত কয়েক দিনে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যদিও এই সংখ্যা সম্পূর্ণ নয়। একদিন এ নিয়ে কথা উঠবে, তদন্ত হবে এবং বিচারও হবে।
মানুষ কেন রাস্তায় নেমে এসে ধ্বংসাত্মক কাজ করছে, তাদের এসব কে শিখিয়েছে? আমাদের রাজনীতিবিদরাই শিখিয়েছেন। গাড়ি পোড়ানো, ভবনে আগুন দেওয়া—এটাই তো আমাদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ যদি কোনো দিন বিরোধী দলে যায়, তাহলে তারাও এ রকম কাজ করবে। সরকার বলছে, দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ তাদের রুটি-রুজির জন্য ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। সরকার কি তাদের কথা বিবেচনা করেছে?

আরো পড়ুন
আমরা এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এবং কেউই জানে না পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে। মানুষের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। একদিকে আন্দোলনকারীরা সম্পূর্ণ শাটডাউনের কথা বলছেন, অন্যদিকে সরকার দিয়েছে কারফিউ। ফলে দুই দিক থেকেই সবকিছু বন্ধ। এর মধ্যেই বিক্ষিপ্ত সংঘাত এবং গোলাগুলি চলছে।
সরকার যদি আক্রমণাত্মক ভূমিকা থেকে সরে না আসে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সরকার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ, র্যাব, এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে রংপুরে আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হলো? এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উসকানিমূলক কাজ।
আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ফসল ছিনতাই হয়ে গেছে, এবং গণতন্ত্র এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।