আমেরিকার কূটনীতি ইরান যুদ্ধ
ইরান যুদ্ধ: জনমত তৈরিতে কেন ব্যর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র? গভীর বিশ্লেষণ


- আপডেট সময় : ০১:৩১:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ ৬২ বার পড়া হয়েছে
আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যেখানে যুদ্ধ যেন অনিবার্য মনে হচ্ছিল। তবে সেই যুদ্ধের বাস্তবায়ন হয়নি — অন্তত এখন পর্যন্ত। ইরান যুদ্ধ: জনমত তৈরিতে কেন ব্যর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র? গভীর বিশ্লেষণ
প্রশ্ন হচ্ছে, এতবার হুমকি ও সামরিক প্রস্তুতির পরেও কেন যুদ্ধ শুরু হয়নি? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো — কেন আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ জনমত তৈরি করতে ব্যর্থ হলো?
১. মার্কিন জনগণের যুদ্ধবিরোধী মনোভাব


২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা মার্কিন জনমনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ তুলে যুদ্ধ শুরু করা হলেও, সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এতে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের ওপর আস্থা কমে যায়।
নতুন করে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়ে জনগণ ভীত, কারণ তারা জানে—যুদ্ধ মানেই দীর্ঘদিনের সামরিক উপস্থিতি, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, এবং আমেরিকান সেনাদের মৃত্যু।
২. মিডিয়ার দ্বিধান্বিত ভূমিকা
ইরাক যুদ্ধের সময় অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রশাসনের পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা সাবধান ছিল। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ অনেক প্রভাবশালী গণমাধ্যম ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে, “ইরান কি সত্যিই এমন হুমকি যেটি যুদ্ধ ছাড়া মোকাবেলা করা যাবে না?”
এমন মিডিয়া কভারেজ জনমনে সন্দেহ তৈরি করে এবং যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. ইউরোপের দ্বিমত ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব
যেকোনো বড় ধরনের সামরিক অভিযানে আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। বিশেষ করে ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের নিউক্লিয়ার ডিল (JCPOA) রক্ষা করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে, তখন ইউরোপ হতাশ হয় এবং ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নিতে আগ্রহী হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র একা পড়ে যায়।
৪. ইরানের সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা
ইরাক বা আফগানিস্তানের চেয়ে ইরান অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র। দেশটির রয়েছে প্রশিক্ষিত রেভল্যুশনারি গার্ড, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ও বিশাল মিলিশিয়া নেটওয়ার্ক।
যুক্তরাষ্ট্র জানে—ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ মানেই শুধু তেহরান নয়, বরং সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, এমনকি ইসরায়েল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া একটি সংঘাত। এই জটিলতা বিবেচনায় এনে অনেকেই যুদ্ধের বিরোধিতা করেন।
৫. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন এই মুহূর্তে দুই ভাগে বিভক্ত: রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট। ডেমোক্র্যাটরা সাধারণত শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক পন্থার পক্ষে। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের যুদ্ধোন্মুখ নীতির বিরোধিতা করেছে। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পরেও ইরান নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নিতে চেয়েছে।
এই বিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়া বড় সামরিক অভিযান চালানো জনমত ও রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া অসম্ভব।
৬. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ক্লান্তি
যুক্তরাষ্ট্র বিগত দুই দশক ধরে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ চালিয়েছে। এতে শুধু আর্থিক ক্ষতি হয়নি, বরং সেনাবাহিনীর উপর চাপ, ভেটেরানদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং বিশ্বজুড়ে আমেরিকার ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই যুদ্ধ ক্লান্তি আমেরিকান জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইরানের সঙ্গে নতুন সংঘাতে জড়াতে অনিচ্ছা সৃষ্টি করেছে।
৭. চীনের উত্থান এবং কৌশলগত অগ্রাধিকার
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিযোগী হলো চীন। বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত মনোযোগ দিচ্ছে। চীনের সঙ্গে প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সামরিক প্রতিযোগিতা এ মুহূর্তে আমেরিকার প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ফলে ইরানের সঙ্গে বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু করলে সেই মনোযোগ ভিন্নখাতে চলে যাবে, যা আমেরিকার বৈশ্বিক কৌশলে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
৮. অর্থনৈতিক বিবেচনা
ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা মানে বিশাল সামরিক ব্যয়। মার্কিন বাজেটে যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা কঠিন। সেই সঙ্গে তেল দামের ওপর প্রভাব পড়ে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে, যা বিশ্বব্যাপী মার্কিন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি এবং চেইন সাপ্লাই সংকটের সময় মার্কিন প্রশাসন নতুন কোনো সামরিক খাতে বিপুল ব্যয় করতে চায় না।
সব মিলিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার মতো সামর্থ্য ও সামরিক প্রস্তুতি থাকলেও, জনমত, রাজনৈতিক বিভক্তি, আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব এবং কৌশলগত বাস্তবতা আমেরিকাকে পিছিয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের হুমকি দিয়ে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে, কিন্তু একে যুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পথ তারা খুঁজে পায়নি বা চায়নি।
এটি একটি স্পষ্ট বার্তা যে, ২১ শতকে যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে হয় না—এতে লাগে তথ্য, জনমত এবং বৈশ্বিক কৌশল। আমেরিকা সেই যুদ্ধে পরাজিত, অন্তত এখন পর্যন্ত।












One thought on “ইরান যুদ্ধ: জনমত তৈরিতে কেন ব্যর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র? গভীর বিশ্লেষণ”