আত্মসমর্পণ নয়, সম্মানের পথে এগিয়ে চলবে ইরান—খামেনির ভাষণ
ইরানকে কেউ দমন করতে পারবে না খামেনির কড়া বার্তা


- আপডেট সময় : ০১:০৬:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫ ৫১ বার পড়া হয়েছে
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরান একটি অন্যতম আলোচিত রাষ্ট্র। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক, পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির একটি তীব্র বার্তা নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন—”ইরান কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না। কেউ যদি আমাদের উপর চাপিয়ে শান্তি বা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, আমরা তা মেনে নেব না।”
🔶 খামেনির বক্তব্যের মূল সুর:
ইরানের রাজধানী তেহরানে এক বিশেষ সমাবেশে দেওয়া ভাষণে খামেনি বলেন:
“আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নেব। কেউ আমাদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করতে পারবে না, আবার কেউ আমাদের শান্তির নামে নতজানু করতে পারবে না। ইরান আত্মসমর্পণ করবে না, এটা আমাদের জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন।”
এই বক্তব্য স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বর্তমানে তীব্র উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সংঘর্ষ বা বড় ধরণের কূটনৈতিক সংকটের দিকে এগোতে পারে।
🔶 পেছনের প্রেক্ষাপট:
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। ২০১5 সালের ঐতিহাসিক Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে সরে যাওয়ার পর থেকেই ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা, ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং ইয়েমেন-সিরিয়ায় প্রক্সি যুদ্ধ ইত্যাদি ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরান প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছে।
🔶 “চাপিয়ে দেওয়া শান্তি” মানে কী?
খামেনি তাঁর বক্তব্যে বারবার “চাপিয়ে দেওয়া শান্তি” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে এমন একরকম শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করতে চায়, যেখানে ইরানের স্বার্থ ও মর্যাদার কোনো স্থান নেই। এক ধরনের ‘আত্মসমর্পণের চুক্তি’ – যা বাস্তবিক অর্থে শান্তি নয়, বরং আধিপত্যের মাধ্যম।
এই শান্তি “জয়ীদের শান্তি”, যেখানে পরাজিত পক্ষ হিসেবে ইরানকে সমস্ত শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করা হবে। খামেনির মতে, এই ধরনের শান্তি ইসলামিক রেভ্যুলুশনের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
🔶 যুদ্ধের হুমকি ও প্রস্তুতি:
খামেনি কেবল আত্মসমর্পণ না করার বার্তাই দেননি, বরং বলেছেন—
“যদি যুদ্ধ হয়, তবে আমরা প্রস্তুত। আমাদের জনগণ জানে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়। আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু কেউ যদি তা চাপিয়ে দেয়, আমরা পাল্টা জবাব দেব।”
ইরানের সামরিক বাহিনী সম্প্রতি বেশ কিছু মিসাইল পরীক্ষায় সফলতা পেয়েছে এবং দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
🔶 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:

খামেনির এই বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কূটনৈতিক পথেই সমস্যার সমাধান চায় বলে জানিয়েছে, তবে তারা ইরানের এই ধরনের আগ্রাসী বার্তাকে হুমকি হিসেবেই দেখছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান পশ্চিমা চাপে নমনীয় না হয়ে বরং তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শে অনড় থাকার কৌশল নিয়েছে।
🔶 ইসরায়েল ও সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া:
ইরানের এই বার্তার পর সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ইসরায়েল এবং সৌদি আরব। ইসরায়েল আগে থেকেই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে আসছিল। ইরানের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধের আরও যুক্তি তৈরি করতে পারে।
সৌদি আরব যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে, তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যদি আরও শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে সৌদি শিবিরে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
🔶 অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব:
ইরানের এই কঠোর অবস্থান দেশের অভ্যন্তরেও প্রভাব ফেলছে। দেশের রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তি খামেনির এই বক্তব্যকে সমর্থন করলেও, সংস্কারপন্থীরা আশঙ্কা করছেন যে, এই অবস্থান ইরানকে আরও একঘরে করে তুলবে।
তবে দেশের জনগণের একাংশ এই বক্তব্যকে “জাতীয় মর্যাদা রক্ষার প্রতীক” হিসেবেই দেখছে।
🔶 আগামী দিন কী দেখাবে?
খামেনির বক্তব্য যদি বাস্তবায়নের দিকে এগোয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং ইউরোপের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও কঠিন হবে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন এর মতো শক্তিধর মিত্রদের সহযোগিতা নিয়ে ইরান যদি চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়, তবে নতুন এক শক্তির জোট গড়ে উঠতে পারে।
🔶 শেষ কথা:
আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির এই বক্তব্য নিছক কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। এটি ইরানের রাষ্ট্রীয় অবস্থানের প্রতিফলন। “চাপিয়ে দেওয়া শান্তি বা যুদ্ধ” – এই শব্দগুলো শুধু কূটনৈতিক না, বরং এক আদর্শিক সংঘাতের প্রতীক।
ইরান আগামী দিনগুলোতে কেমন পদক্ষেপ নেয়, সেটা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্ব রাজনীতির গতিপথকেও প্রভাবিত করবে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এই বক্তব্য আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একটি জাতি যদি আত্মসমর্পণ না করার শপথ নেয়, তবে তাকে চাপে ফেলেও দমন করা যায় না। শান্তি হোক বা যুদ্ধ—সেটা হতে হবে সম্মানের ভিত্তিতে, চাপের নয়।












