মার্করামের সেঞ্চুরি
ইতিহাস লিখলেন মার্করাম Trophy winning hero


- আপডেট সময় : ০৩:৪৪:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫ ৮৮ বার পড়া হয়েছে
একজন মার্করাম, একটি সেঞ্চুরি এবং ২৭ বছর পর একটি ট্রফি
ক্রিকেট শুধু একটি খেলা নয়—এটি আবেগ, জাতীয় গর্ব, দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আর ব্যর্থতার গল্প। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এই খেলার মানে আরও গভীর। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণের পর থেকে বারবার সেমিফাইনালে হোঁচট খাওয়া, বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বিদায়, আর ‘চোকার্স’ (chokers) নামক কুখ্যাত উপাধি—এই ছিল তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের ছায়া। কিন্তু ২০২৫ সালের শুরুর দিকে ইতিহাসের গতিপথ বদলে গেল। এক ব্যক্তির ব্যাটিং নৈপুণ্যে, একটি দল ঐক্যের গল্পে, আর একটি ট্রফির হাতছানিতে—দক্ষিণ আফ্রিকা অবশেষে জিতল।
ইতিহাস লিখলেন মার্করাম Trophy winning hero
এই গল্প একজন আয়ডেন মার্করামের। একজন ব্যাটসম্যান, একজন নেতা এবং একজন ইতিহাস লেখক।
২৭ বছরের প্রতীক্ষার যন্ত্রণা
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলেও বড় কোনো বিশ্ব আসরে তাদের অর্জন শূন্যই থেকে যায়। সেই সময়ের হ্যানসি ক্রোনিয়ে, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স, গ্রায়েম স্মিথ, স্টেইন-বোল্যান্ডের বোলিং জুটি—সবারই মুকুটে বিশ্বকাপের পালক যোগ হয়নি। বারবার সেমিফাইনালে হেরে গিয়ে ‘চোকার্স’ শব্দটি যেন দলটির কপালে স্থায়ীভাবে বসে যায়।
২৭ বছরের অপেক্ষা: দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রফি খরা অবশেষে কাটল


সেই হতাশার ধারাবাহিকতা বদলাতে ২০২৫ সালে মাঠে নামেন আয়ডেন মার্করাম ও তার দল।
এক ঐতিহাসিক ইনিংস: মার্করামের সেঞ্চুরি
ফাইনালের দিন। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, যাদের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস কখনোই খুব সুখকর ছিল না। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে দলটির শুরু ছিল টালমাটাল। ৩ উইকেট পড়ে গেছে মাত্র ৪৫ রানে। এমন সময় উইকেটে আসেন মার্করাম।
তাঁর ব্যাট ছিল দৃঢ়, শান্ত ও পরিকল্পিত। প্রথম ৫০ রান আসে ধৈর্য ধরে, তারপর রানের গতি বাড়িয়ে তোলেন তিনি। অফসাইডে তাঁর কভার ড্রাইভ, মিডউইকেটে পুল শট—সবকিছুই ছিল দৃষ্টিনন্দন। ১২০ বলে ১০৮ রানের এক দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে তিনি দলকে ২৭৮ রানের সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছে দেন।
ম্যাচের রোমাঞ্চ ও নাটকীয় সমাপ্তি
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে শুরু থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এনরিখ নরকিয়া ও কাগিসো রাবাদা বল হাতে আগুন ছুড়ছিলেন। মিডল ওভারে স্পিনার মাহারাজও দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন। শেষ পাঁচ ওভারে ম্যাচ যখন দুলছিল, তখন ডেথ ওভারে বোল্যান্ডের দুটি উইকেট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
শেষ ওভারে দরকার ১০ রান, হাতে ১ উইকেট। চাপ, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, টিভির সামনে কোটি ভক্ত। কিন্তু মার্করামের এক সাহসী ফিল্ড সেটিং এবং ডেলিভারির জবাবে লং অনে এক ক্যাচ, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শতাব্দীর প্রতীক্ষার সমাপ্তি।
একজন নেতা, একজন ইতিহাস রচয়িতা
মার্করাম শুধু সেঞ্চুরি করেননি, তিনি ছিলেন দলের মেরুদণ্ড। তাঁর অধিনায়কত্বে শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের ছাপ ছিল স্পষ্ট। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা বুঝে ফিল্ড পরিবর্তন, ব্যাটিংয়ে চাপের মুহূর্তে দায়িত্ব নেওয়া—সবকিছুই এক নেতৃত্বের নিখুঁত উদাহরণ।
তিনি যে কেবল একজন ব্যাটসম্যান নন, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট পুনর্জাগরণের প্রতীক, তা এ জয় প্রমাণ করে দিয়েছে।
ড্রেসিংরুমের আবেগ ও উৎসব
ম্যাচ শেষে যখন বিজয় নিশ্চিত হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে যে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটে, তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। কেউ কাঁদছেন, কেউ হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন, আবার কেউ সাদা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন।
প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা টুইট করে আবেগপ্রবণ বার্তা দিয়েছেন। জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে। কেপটাউনের টেবিল মাউন্টেন, জোহানেসবার্গের গলিতে, এবং সুদূর প্রিটোরিয়ার স্কুলে বাজছে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত।
ইতিহাসের পুনর্যেখা: ১৯৯৯ বনাম ২০২৫
অনেকে বলছেন, ২০২৫-এর এই ফাইনাল ছিল ১৯৯৯ সালের ট্র্যাজেডির প্রতিক্রিয়া। ১৯৯৯ সালে সেই ইনফেমাস রানআউটের ঘটনায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙে যায়। কিন্তু ২০২৫ সালে দলটি শেষ ওভারে ধৈর্য হারায়নি, বরং দেখিয়েছে পরিণত মনোভাব।
এই জয় তাই শুধুই একটি ট্রফি জেতার গল্প নয়, বরং একটি জাতি হিসেবে দাগ কাটার এবং অতীতের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার গল্প।
ক্রিকেটবিশ্বের প্রতিক্রিয়া
এই জয়ের পর ক্রিকেটবিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকার প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে। আইসিসি সভাপতি বলেন, “এটি কেবল একটি জয়ের গল্প নয়, এটি লেগেসি বদলে দেওয়ার গল্প।”
শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে বিরাট কোহলি, মাইকেল ভন, ওয়ার্নার—সকলেই টুইট করে অভিনন্দন জানান।
একজন নেতা, একটি ইনিংস, একটি জাতির স্বপ্নপূরণ
কোচিং স্টাফ ও সাপোর্ট টিমের অবদান
জয়ের পিছনে একটি বড় অবদান ছিল কোচিং টিম ও বিশ্লেষকদের। ব্যাটিং কোচের পরিকল্পনায় ওপেনিং পজিশনে গঠনমূলক পরিবর্তন, স্পিন কোচের ইনপুটে মিডল ওভারে নিয়ন্ত্রণ এবং সাইকলজিকাল কোচের ভূমিকা—সবকিছুই দলকে পরিণত করেছে একটি জয়ী ইউনিটে।
এই জয় দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎকে কীভাবে বদলাবে?
এই ট্রফি শুধু অতীত মুছে দেওয়ার প্রতীক নয়; এটি একটি নতুন যাত্রার সূচনা। জুনিয়র খেলোয়াড়রা এখন জানবে, দক্ষিণ আফ্রিকাও বিশ্বজয় করতে পারে। ইনভেস্টরদের আগ্রহ বাড়বে, ঘরোয়া ক্রিকেটে উন্নয়ন হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, ‘চোকার্স’ শব্দটি হয়তো এবার চিরতরে মুছে যাবে।












